বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ অপরাহ্ন
কালের খবরক প্রতিবেদন :
প্রাইভেট কারে বাংলামোটর থেকে মগবাজার ফ্লাইওভার দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। কিছুদূর এগোনোর পর দেখতে পান সামনে একটি গাড়ি আড়াআড়ি করে রাখা।
প্রাইভেট কারের গতি কমিয়ে তিনি হর্ন বাজাতে থাকেন। সাড়াশব্দ না পেয়ে একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নামতেই পড়ে যান ভয়াবহ বিপদের মুখে। আড়াআড়ি করে রাখা গাড়ি থেকে নেমে তিন অস্ত্রধারী যুবক তাঁকে ঘিরে ফেলে। অস্ত্রের মুখে বেধড়ক পিটিয়ে হাত-পা বেঁধে তাঁর কাছ থেকে গাড়ির চাবি কেড়ে নেয় ওই তিন যুবক। এরপর গাড়িটি নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। আহত সাইফুল ইসলামকে পরে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কালের খবরকে সম্প্রতি এই ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা জানান তিনি।
রাতে সরেজমিন মগবাজারকেন্দ্রিক ফ্লাইওভারটির বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। সরেজমিনে এলাকাটির ফ্লাইওভারের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্থানে ল্যাম্পপোস্টের আলো নেই।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফ্লাইওভারের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদ্যুৎ খুঁটির গোড়া থেকে বৈদ্যুতিক তার কেটে নিয়ে গেছে চোরেরা। এ কারণে ল্যাম্পপোস্টের লাইট জ্বলে না। সেই সঙ্গে মূল ফ্লাইওভারের ওপর নেই সিসি টিভি ক্যামেরা। সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণে ফ্লাইওভারের ওপরে ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
ফ্লাইওভারসংলগ্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফ্লাইওভার উদ্বোধনের কিছুদিনের মধ্যেই ল্যাম্পপোস্টের লাইটে আলো নেই। এ নিয়ে কারো মাথাব্যথাও নেই।
ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ল্যাম্পপোস্টের খুঁটির গোড়া থেকে বিদ্যুতের তার কেটে নিয়ে গেছে চোরেরা। বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়েছে। ওই বিদ্যুৎ খুঁটিগুলোয় বিদ্যুতের তার লাগিয়ে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে।
রাজধানীতে মোট সাতটি ফ্লাইওভারের মধ্যে সর্বশেষ মগবাজারকেন্দ্রিক ফ্রাইওভারটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে কুড়িল ফ্লাইওভারটিও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। মহাখালী, খিলগাঁও, বনানী ও তেজগাঁও এলাকায় আরো চারটি ফ্লাইওভার রয়েছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে এসব ফ্লাইওভার বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এই ফ্লাইওভারগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় কার্যত এগুলো অরক্ষিত। অপরাধী, ছিনতাইকারীদের ভয়ে রাতে ফ্লাইওভারগুলো ব্যবহারকারী প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল আরোহীরা যখন-তখন বিপদে পড়ছেন। সেই সঙ্গে মাদকসেবীদের দখলে বেশির ভাগ ফ্লাইওভার। যেভাবে ফুটওভার ব্রিজগুলো আগে থেকে দখল করে নিয়েছে মাদকাসক্ত ও বখাটেরা। বেশির ভাগ ফ্লাইওভারের নিচে ভোরবেলায়ও চলে মাদক সেবন ও বিক্রি। আর সন্ধ্যার পর শুরু হয় ছিনতাইকারীদের সন্ত্রাস। ফ্লাইওভারের ওপর তারা গাড়ি পার্ক করে সাধারণ মানুষের মতো আড্ডা দেয়। ছিনতাইয়ের জন্য অপেক্ষা করে। ফ্লাইওভারের কাছাকাছি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। অরক্ষিত ফ্লাইওভার ব্যবহারকারীরা রাতে বিপদে পড়লে সহযোগিতার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের খুঁজে পায় না।
গত মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে কুড়িল ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীরা গাড়ি থামাতে ব্যর্থ হয়ে পেছন থেকে ককটেল পর্যন্ত ছুড়ে মেরেছে। একই রাতে খিলগাঁও ফ্লাইওভারে অটোরিকশা দাঁড় করিয়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে।
রবিন নামে এক ভুক্তভোগী কালের খবরকে জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অফিস থেকে সপ্তাহে তিন দিন অফিসের গাড়িতে গভীর রাতে তাঁকে বাসায় ফিরতে হয়। যানজট এড়িয়ে দ্রুত উত্তরা থেকে রামপুরা এলাকায় যেতে কুড়িল ফ্লাইওভার ব্যবহার করেন চালক। সম্প্রতি এক রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে রবিন জানান, গভীর রাতে প্রাইভেট কারে করে তিনিসহ কয়েকজন সহকর্মী অফিসের গাড়িতে বাসায় ফিরছিলেন। কুড়িল ফ্লাইওভারে ওঠার পর দূর থেকেই দেখতে পান দাঁড়ানো একটি বাসের পাশে কজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি যেতেই দুজন লোক হাত তুলে তাঁদের গাড়ি থামাতে সংকেত দেয়। বিপদ হতে পারে ভেবে তিনি চালককে দ্রুত টানতে বলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ির পেছন দিকে বিকট শব্দ শুনতে পান। তাকিয়ে দেখেন, ছিনতাইকারীরা ককটেল ছুড়েছে। সামনে এগিয়ে খোঁজ করেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে পাওয়া যায়নি।
খিলগাঁও ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের শিকার ব্যবসায়ী আমজাদ বলেন, রামপুরা এলাকায় তাঁর মুদি দোকান। প্রয়োজনীয় কিছু মাল নিয়ে মতিঝিল থেকে তিনি ফিরছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে তিন যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁর অটোরিকশার সামনে চলে আসে। চালক গাড়ি থামাতে বাধ্য হন। এরপর দুর্বৃত্তরা পিস্তল ঠেকিয়ে এবং চিৎকার না করে সব দিয়ে দিতে বলে। ভয়ে তিনি তাঁর কাছে থাকা তিন হাজার টাকা ও মোবাইলটা দিয়ে দেন। আরো টাকা চেয়ে পিস্তলের বাঁট দিয়ে তাঁর হাতে আঘাত করে দুর্বৃত্তরা।
তেজগাঁও কলেজছাত্র আফজাল বলেন, ফার্মগেট থেকে একটি বাসে তেজগাঁও ফ্লাইওভারের পশ্চিম প্রান্তে নামেন তিনি। তখন রাত ১১টা ১০ মিনিট। হেঁটে ফ্লাইওভারের মাঝখানে আসতেই কজন যুবক তাঁকে থামিয়ে মোবাইল ফোন ও কাছে থাকা ৩০০ টাকা নিয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা এরপর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কোনো কথা না বলে সোজা চলে যেতে বলে।
এ ছাড়া গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কুড়িল ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীরা একটি দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞাপন নির্বাহী ফারুক আহমেদ ফরহাদকে তাঁর পকেটে থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম কার্ড নিয়ে চলন্ত প্রাইভেট কার থেকে ফেলে দেয়। পরে তারা তাঁর কার্ড দিয়ে ৪০ হাজার টাকা তুলে নেয়। একই ফ্লাইওভারের ওপর কদিন আগে রাতে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারও করে।
গত বছর খিলগাঁও ফ্লাইওভারের ওপর থেকে এক তরুণীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় কেউ কেউ থানায় অভিযোগ করলেও বেশির ভাগ ঘটনায় হয়রানির ভয়ে জিডিও করে না ভুক্তভোগীরা। এসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে ন্যূনতম নিরাপত্তাসেবা পাচ্ছে না। অজুহাত হিসেবে পুলিশ বলছে, তাদের লোকবল কম।
গত কয়েক দিনে কালের খবরের অনুসন্ধানে এসব ফ্লাইওভারের ওপর ও প্রবেশমুখে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কোনো ধরনের নিরাপত্তারক্ষী দেখতে পাওয়া যায়নি। পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফুট প্যাট্রল ও মোবাইল টিমও দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভারগুলো রাজধানীর পরিবহনসেবায় কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এলেও রাতের ফ্লাইওভার এখন অনেকের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে যাদের জন্য সরকার ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে, সেই জনগণের ক্ষতি হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ফ্লাইওভারগুলোয় নিরাপত্তা বিধান করা। অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মগবাজার ফ্লাইওভারটি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন হলেও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে পুরোপুরি বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। তাই বিদ্যুতের স্বল্পতার বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে এলেও আপাতত আমাদের কিছু করার নেই। ’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক দক্ষিণ) মো. মফিজ উদ্দিন আহমেদ কালের খবরকে বলেন, রাতে ফ্লাইওভারের দিকে তাদের (ট্রাফিক বিভাগ) নজরদারি কম থাকে। তবে ফ্লাইওভারের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ পুলিশের ক্রাইম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত বলে তিনি মনে করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের মুখে নজরদারি বাড়াতে হবে যাতে যানজটের সৃষ্টি না হয়। সিটি করপোরেশন ও পুলিশ মিলে ফ্লাইওভারের নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে। যেহেতু লোকবল একটি সমস্যা। তাই এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন বেসরকারি সিকিউরিটি সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নিতে পারে। ডিএমপির ক্রাইম ডিভিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে ট্রাফিক বিভাগের সুপারিশ জানানো হবে। সিসি ক্যামেরা স্থাপন সিটি করপোরেশনের এখতিয়ার, ট্রাফিক বিভাগের নয়। আইন-শৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব ডিএমপির ক্রাইম বিভাগের।
মগবাজার ফ্লাইওভারে গাড়ি দাঁড় করে রাতে ছিনতাই চলে—এমন একটি খবর দিলে তিনি বলেন, গভীর রাতে ফ্লাইওভারের ওপর ট্র্যাফিক থাকে না। তবে ছিনতাইয়ের ঘটনা দেখতে রাতে পুলিশের ফুট পেট্রল টিম রয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, রাজধানীর নিরাপত্তাব্যবস্থায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও কাজ করে। তবে যে পরিমাণ জনবল দরকার তা তাদের নেই। এর পরও প্রয়োজনে ফ্লাইওভারসহ সব জায়গায়ই র্যাবের টিম কাজ করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ফ্লাইওভার অনিরাপদ—এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। তবে মাঝেমধ্যে এ রকম অভিযোগ পাওয়া যায়। আবার অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। রাতে টহল পুলিশের পাশাপাশি থানার পুলিশও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপরাধ ঘটলে কোন থানা এলাকায় ঘটল সেটা বড় কথা নয়, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ কাজ করছে।
কালের খবর -/৮/৪১৮